মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে এক রহস্যময় যাত্রা। আধুনিক মানুষ, অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্স, কীভাবে পৃথিবীতে এলো—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা যুগের পর যুগ গবেষণা চালিয়েছেন। নানা মত, ধর্মীয় ব্যাখ্যা বা সংস্কৃতির কাহিনী থাকলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতবাদ হলো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। কারণ বৈজ্ঞানিক মত কেবল ধারণা নয়, বরং উপাত্ত ও প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে।
পৃথিবীতে জীবনের সূচনা
প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে জীবনের জন্ম ঘটে। তবে আধুনিক মানব সদৃশ প্রাণীর আবির্ভাব হয়েছিল অনেক পরে, প্রায় ৭০ লক্ষ বছর আগে। প্রথমদিকে তারা ছিল প্রাইমেট, যারা গাছে বসবাস করত এবং সেখান থেকেই ধীরে ধীরে তারা মাটিতে দাঁড়ানো শিখে যায়। সেই মুহূর্ত থেকেই সভ্যতার ভিত্তি রচিত হতে থাকে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিকথা — সূর্য অস্ত না যাওয়া শক্তির ইতিহাস
হোমিনিডদের বিবর্তন
মানুষের এই দীর্ঘ বিবর্তনীয় যাত্রায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে। আফ্রিকার বুকে প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে দেখা মেলে অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতির, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো “লুসি” নামক ফসিল। তারা এখনো আধুনিক মানুষের পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করেনি, কিন্তু তাদের মধ্যেই ছিল ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রার ইঙ্গিত।
এরপর প্রায় ২৫ থেকে ১৫ লক্ষ বছর আগে আসে হোমো হাবিলিস। তাদের মস্তিষ্ক ছিল তুলনামূলক বড়, আর তারাই প্রথম পাথরের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার শুরু করে। ধীরে ধীরে তাদের আচরণে প্রকাশ পেতে থাকে মানবীয় বৈশিষ্ট্য।
আরও এক ধাপ অগ্রসর হয় প্রায় ১৫ লক্ষ বছর আগে, যখন পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে হোমো ইরেকটাসের। এই প্রজাতিই প্রথম আগুনের ব্যবহার শুরু করে, শিকার ও আশ্রয় নির্মাণে দক্ষ হয়ে ওঠে, এবং আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ ও এশিয়ায়। তাদের হাতিয়ার ও সরঞ্জাম ছিল উন্নততর, আর তারাই প্রকৃতপক্ষে মানব সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে।
একই ধারার পরিণতিতে প্রায় ১.৬ লক্ষ বছর আগে জন্ম নেয় হোমো স্যাপিয়েন্স ইডালটু নামক উপপ্রজাতি। পরে তাদের থেকেই উদ্ভূত হয় আজকের আধুনিক মানুষ—হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স।
প্রাচীন সভ্যতার ধাপ
মানব সভ্যতার বিকাশ শুধুমাত্র শারীরিক বিবর্তনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সেই সঙ্গে এগিয়ে চলেছিল জ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রায় ৩৬ থেকে ২৫ লক্ষ বছর আগে শুরু হয় লোমেকউই সভ্যতা। কেনিয়ানথ্রোপাস নামে পরিচিত এ প্রজাতি প্রথম পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করে শিকার ও কাঠ সংগ্রহে দক্ষতা অর্জন করেছিল।
পরবর্তী ধাপে, প্রায় ২৫.৮ লক্ষ বছর আগে আবির্ভূত হয় ওল্ডোয়ান সভ্যতা। এখানে হোমো ইরেকটাসেরা দুই পায়ে হেঁটে বেড়ানো শুরু করে, প্রথমবারের মতো আশ্রয় নির্মাণ করে এবং তাদের মস্তিষ্কের আকার ছিল ৯০০ থেকে ১১০০ সিসি পর্যন্ত। এগুলো আধুনিক মানুষের দিকে অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।
বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী কয়েকটি সাম্রাজ্য
নিয়ান্ডারথাল বনাম আধুনিক মানুষ
মানব বিবর্তনের পথে এক সময় হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্সের পাশাপাশি ইউরোপ ও এশিয়ায় বাস করত নিয়ান্ডারথালরা। তাদেরই প্রথম মৃতদেহ সমাধি দেওয়ার প্রথা চালু করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কঠিন প্রতিকূলতা ও প্রতিযোগিতার কারণে প্রায় ২০ হাজার বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। টিকে থাকে কেবল আধুনিক মানুষ।
উপসংহার
মানব সভ্যতার ইতিহাস এক দীর্ঘ বিবর্তনের গল্প। অস্ট্রালোপিথেকাস থেকে শুরু করে হোমো হাবিলিস, হোমো ইরেকটাস এবং অবশেষে হোমো স্যাপিয়েন্স—এই ধারাবাহিক যাত্রাই গড়ে তুলেছে আজকের মানুষকে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করে যে, মানুষের এই বিবর্তন শুধু দেহগত পরিবর্তন নয়, বরং জ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির বিকাশেরও ইতিহাস। আর সেই কারণেই মানব সভ্যতা হলো পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর কাহিনী।
—