সক্রেটিস: নিজেকে জানো
পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাস এ সক্রেটিস এমন এক নাম, যিনি কোনো বই লিখেননি, তবুও দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। তার বিখ্যাত উক্তি—“আমি শুধু এটুকুই জানি যে আমি কিছুই জানি না”—আজও মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। জ্ঞানের সূচনা তিনি দেখেছিলেন আত্মপরিচয়ের ভেতর থেকে, তাই তার মূল দর্শন ছিল “নিজেকে জানো” (Know Thyself)।
সক্রেটিস খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬৯ সালের দিকে এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তার বাবা ছিলেন পাথরের মিস্ত্রি আর মা ছিলেন ধাত্রী। শৈশবে সংসার সচ্ছল না হলেও জ্ঞানপিপাসা তাকে ছোটবেলা থেকেই আলাদা করে তোলে। এথেন্সের নিয়মমাফিক তিনি যুদ্ধেও অংশ নেন, তবে পরবর্তীতে যুদ্ধের প্রতি তীব্র বিরূপতা জন্ম নেয়। এরপর তিনি জীবন উৎসর্গ করেন সত্য অনুসন্ধান ও জ্ঞানের সাধনায়।
দর্শনের ইতিহাসঃ পর্ব ১।প্রাচীন গ্রীক দর্শনের উত্থান ও সক্রেটিস-পূর্ব দার্শনিকদের অবদান
সক্রেটিসের বিশেষত্ব ছিল তার প্রশ্ন করার ভঙ্গি। তিনি কখনো সরাসরি জ্ঞান বিতরণ করতেন না, বরং আলাপচারিতার মাধ্যমে মানুষের চিন্তার অসঙ্গতি প্রকাশ করতেন। তার মতে, সত্যকে জানতে হলে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে যুক্তি দিয়ে যাচাই করতে হবে। তিনি বলতেন, মন্দ কোনো কাজ কোনোভাবেই করা যাবে না, আর যারা সঠিক-ভুল বোঝে না তারাই অন্যায় করে। এই নৈতিক দর্শন তাকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করলেও, ক্ষমতাবানদের চোখে তিনি অস্বস্তিকর হয়ে ওঠেন।
সক্রেটিসের বিচার ও মৃত্যু
শেষ পর্যন্ত ধর্ম অবমাননা, রাষ্ট্রবিরোধী চিন্তা ছড়ানো এবং তরুণদের বিপথে পরিচালিত করার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিষ পান করে তিনি বিদায় নিলেও রেখে যান এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক, অমর দার্শনিক
উত্তরাধিকার, যা পরবর্তী প্রজন্মকে আলো দেখিয়েছে।
পিথাগোরাসের দর্শন: সংখ্যা, সঙ্গীত ও আত্মার রহস্য
প্লেটো: দর্শনের শৃঙ্খলিত পথিক
সক্রেটিসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত শিষ্য ছিলেন প্লেটো। খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭ সালে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এই দার্শনিকের মূল নাম ছিল এরিস্টক্লেস, তবে তার প্রশস্ত শরীরের কারণে তিনি পরিচিত হন “প্লেটো” নামে।
বিশ বছর বয়সে তিনি সক্রেটিসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু মৃত্যুর পর প্লেটো ভ্রমণ করেন ইতালি, মিশর ও সিসিলি—যেখানে বিভিন্ন জ্ঞানীর সাথে তার মতবিনিময় হয়। দেশে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করেন “অ্যাকাডেমি”, যা ছিল পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়-ধর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
প্লেটোর লেখনী
প্লেটো দর্শনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দর্শনকে সুশৃঙ্খল আকার দেন। তার লেখার ধরণ ছিল কথোপকথন বা ডায়ালগ, যেখানে সক্রেটিস ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার প্রাথমিক রচনায় মূলত নৈতিকতা ও ধর্ম, মধ্যবর্তী রচনায় আত্মার অমরত্ব ও ভালোবাসার দর্শন, আর পরবর্তী রচনায় বিশ্লেষণমূলক যুক্তি উঠে আসে।
তার বিখ্যাত গ্রন্থ “রিপাবলিক”-এ তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র এঁকেছেন, যেখানে শাসক হবেন একজন “দার্শনিক-রাজা” (Philosopher King)। তার মতে, আসক্তি ও লোভ থেকে মুক্ত হয়ে কেবল প্রজ্ঞার আলোয় রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়া উচিত।
প্লেটোর দর্শন
প্লেটো বিশ্বাস করতেন—মানুষ ইন্দ্রিয় দিয়ে সত্যকে পুরোপুরি জানতে পারে না। তিনি বলেছিলেন, আমরা যে জগত দেখি তা কেবল আসল জগতের ছায়া। সত্যিকারের জ্ঞান আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সেই জ্ঞানই মানুষকে প্রজ্ঞার দিকে নিয়ে যায়। তার এই দর্শন যুগ যুগ ধরে শুধু গ্রীস নয়, সারা বিশ্বের দার্শনিক, চিন্তক ও শাসকদের প্রভাবিত করেছে। তিনি ৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।
এভাবেই সক্রেটিস ও প্লেটো পশ্চিমা দর্শনের ভিত্তি গড়ে দেন। তাদের চিন্তা ও দর্শন মানবসভ্যতার জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, যা আজও আমাদের পথ দেখায়।