পিথাগোরাসের নাম শুনলেই আমাদের প্রথমে মনে আসে গণিতের বিখ্যাত উপপাদ্যের কথা—সমকোণী ত্রিভুজের দুই বাহুর বর্গফলের যোগফল সমান অতিভুজের বর্গফল। কিন্তু পিথাগোরাস কেবল একজন গণিতবিদই নন; তিনি ছিলেন দার্শনিক, আধ্যাত্মিক গুরু এবং এক অনন্য চিন্তাবিদ, যার প্রভাব আজও বিদ্যমান।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিসের সামোস দ্বীপে জন্ম নেওয়া পিথাগোরাস তার সময়ে এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সমসাময়িকরা তাকে শুধুমাত্র গণিতজ্ঞ হিসেবে দেখেননি; অনেকেই বিশ্বাস করতেন তিনি একজন ঐশ্বরিক আত্মা, এমনকি কেউ কেউ বলতেন—তিনি একই সময়ে দুই স্থানে থাকতে পারেন। প্রাচীনকালে মানুষ তাকে ধর্মীয় পণ্ডিত এবং আত্মার ভাগ্য নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখত।
এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব
পিথাগোরাসের নিজস্ব দর্শন গড়ে উঠেছিল একটি মূল বিশ্বাসের উপর। তা হলো; সংখ্যা হচ্ছে বিশ্বজগতের মৌলিক উপাদান। তার মতে, পৃথিবীর সবকিছুই সংখ্যার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। তা হোক সংগীত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, বা মানব আত্মা।
প্রচলিত মতবাদ (পর্ব ২): সাম্রাজ্যবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, জাতীয়তাবাদ ও উদারতাবাদ
সংখ্যা ও সঙ্গীতের সম্পর্কঃ
পিথাগোরাসের দর্শনের অন্যতম বড় অংশ ছিল সঙ্গীত। তিনি আবিষ্কার করেন, সঙ্গীতের সুর এবং সংখ্যার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তার মতে, সঠিক সঙ্গীত শুধু মনকে শান্ত করে না, বরং শরীর ও আত্মার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। অনেক প্রাচীন চিকিৎসা প্রথায় তার এই ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে।
এরিস্টটল পিথাগোরাস সম্পর্কে বলেছিলেন—”সংখ্যাই সব কিছুর মূল, আর বিশ্বজগত একটি সুশৃঙ্খল সংখ্যার সিস্টেম।” এই দৃষ্টিভঙ্গি পিথাগোরাসকে কেবল একজন বিজ্ঞানী নয়, বরং মহাবিশ্বের গভীর দর্শন অনুসন্ধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

নৈতিক শিক্ষা ও জীবনধারা
পিথাগোরাস তাঁর শিষ্যদের জন্য কিছু অদ্ভুত কিন্তু প্রতীকী আচরণবিধি প্রচলন করেছিলেন, যা আক্ষরিক অর্থে যতটা অদ্ভুত শোনায়, ততটাই গভীর অর্থ বহন করত। বার্টান্ড রাসেলের *History of Western Philosophy* গ্রন্থে এরকম দশটি নিয়মের কথা উল্লেখ আছে—
1. পড়ে যাওয়া জিনিস তুলবে না — তুচ্ছ লোভ এড়ানোর শিক্ষা।
2. লোহা দিয়ে আগুন নাড়বে না — ক্রোধ বা হিংসা উসকে না দেওয়ার প্রতীক।
3. সাদা মুরগি স্পর্শ করবে না — পবিত্রতার প্রতি সম্মান।
4. ছাদের উপর চড়ুই পাখি বসতে দেবে না — অযাচিত বিশ্রাম এড়ানো।
5. গাঁদা ফুল ছিড়বে না — প্রকৃতিকে অকারণে ক্ষতি না করা।
6. আলো পাশে রেখে আয়নায় তাকাবে না — আত্মপ্রশংসা ও অহংকার থেকে বিরত থাকা।
7. মহাসড়কে হাঁটবে না — বিপদ ও ভিড় এড়ানোর উপদেশ।
8. কলিজা খাবে না — জীবের প্রতি সহানুভূতি।
9. রুটি ছিড়বে না — একতা ও অখণ্ডতার প্রতীক।
10. ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুছিয়ে ফেলবে — শৃঙ্খলা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের চর্চা।
এসব নিয়মের পেছনে ছিল প্রতীকী অর্থ, সংযম, শৃঙ্খলা এবং প্রকৃতির প্রতি সম্মান। তার মতে, মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা বজায় রাখা মানে আত্মার শুদ্ধি বজায় রাখা।
প্লেটোর গুহার রূপকঃ জ্ঞান ও ভ্রম।
আত্মা ও জন্মান্তরবাদ
পিথাগোরাস বিশ্বাস করতেন আত্মা অমর এবং দেহ কেবল তার বাহক। মৃত্যুর পর আত্মা এক দেহ থেকে আরেক দেহে স্থানান্তরিত হয়, যা আমরা আজ জন্মান্তর বা পুনর্জন্ম ধারণা হিসেবে জানি। তার মতে, আত্মার লক্ষ্য হলো শুদ্ধি অর্জন করা, যাতে জন্ম-মৃত্যুর চক্র ভেঙে ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়া যায়।
নারী-পুরুষ সমতা
তার সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন পিথাগোরাস। তিনি মনে করতেন নারী ও পুরুষ সমান অধিকার ও সুযোগ পাওয়ার যোগ্য। এমনকি সম্পদের বন্টন ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও সমান অধিকার থাকা উচিত বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। পিথাগোরাসের দর্শন আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে—সংখ্যা, বিজ্ঞান, সঙ্গীত ও নৈতিকতার মধ্যকার গভীর সম্পর্ক বোঝাতে। তার জীবন প্রমাণ করে, সত্যিকারের জ্ঞান শুধু হিসাব-নিকাশে নয়; এটি আত্মাকে শুদ্ধ করা, জীবনে শৃঙ্খলা আনা এবং মহাবিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়ার এক অবিরাম যাত্রা।




