Sunday, October 12, 2025
Google search engine
Homeইতিহাসগত ১০০ বছরে মানব সভ্যতাকে কাঁপিয়ে দেওয়া ৬টি মহামারী

গত ১০০ বছরে মানব সভ্যতাকে কাঁপিয়ে দেওয়া ৬টি মহামারী

মানুষের সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। চিকিৎসা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান—সব কিছুর উন্নতি সত্ত্বেও কিছু অদৃশ্য জীবাণু পুরো পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে বারবার। ভাইরাস আর সংক্রামক রোগ যখন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন কেবল মানুষের প্রাণই কেড়ে নেয় না, সমাজ–অর্থনীতি–রাজনীতির কাঠামোও বদলে দেয়। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস এরই ভয়াল উদাহরণ। তবে এটি একমাত্র নয়। গত শতাব্দীতে আরও বেশ কিছু মহামারী মানুষের জীবন থামিয়ে দিয়েছিল হঠাৎ করেই।

COVID-19: অকেজো নয়, কিন্তু মৃত্যু সংখ্যা আরও বেশি

COVID-১৯ মহামারীর অফিসিয়ালি রিপোর্ট করা মৃত্যুর চেয়ে প্রকৃত মৃত্যু অনেক বেশি । WHO ও অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০-২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪.৮৩ মিলিয়ন মৃত্যু হয়েছে, যা অফিসিয়াল রিপোর্টের প্রায় ২.৭৪ গুণ।

অর্থাৎ, মৃত্যু শুধুমাত্র করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদেরই হয়নি; হাসপাতালে পৌঁছতে না পারা, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা বন্ধ থাকা, অন্যান্য রোগগুলোর প্রভাব—এসব মিলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

জিকা ভাইরাস: মাতৃত্বের স্বপ্নে কালো ছায়া

২০১৫ সালে ব্রাজিলে প্রথম জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই দক্ষিণ আমেরিকার বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এডিস মশা এই ভাইরাস ছড়ায়, আবার যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। গর্ভবতী নারীরা এ ভাইরাস  আক্রান্ত হলে শিশু জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ হয়ে—যা ভয়াবহ আতঙ্ক তৈরি করেছিল। জিকা ঠেকাতে কোনো কার্যকর প্রতিষেধক এখনও নেই। তবে ২০১৭ সালের পর থেকে প্রকোপ অনেকটা কমেছে। এই মহামারী প্রমাণ করে, একটি অঞ্চলের মশা–বাহিত রোগও কিভাবে বৈশ্বিক আতঙ্কে পরিণত হতে পারে।

ইবোলা: মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি

আফ্রিকার গিনিতে ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাস ধরা পড়ে। দ্রুত ছড়িয়ে যায় লাইবেরিয়া আর সিয়েরা লিওনেও। মাত্র এক বছরের মধ্যে প্রায় ২৯ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ১২ হাজারেরও বেশি। বাদুড় থেকে এ রোগের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে নির্গত তরল পদার্থ—থুতু, ঘাম, বমি, মলমূত্র—মহামারীর বিস্তারের মূল কারণ। ভয়ের বিষয় হলো, এখনও পর্যন্ত ইবোলার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই। সংক্রমিত হলে মৃত্যুহার অত্যন্ত বেশি, যা এটিকে বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে ভীতিকর মহামারীগুলোর একটি করেছে।

সোয়াইন ফ্লু: আধুনিক যুগের বিশ্বব্যাপী সতর্কবার্তা

২০০৯ সালে মেক্সিকোতে প্রথম শনাক্ত হয় সোয়াইন ফ্লু বা H1N1। এক বছরের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ৫.৫ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারায়। আশ্চর্যের বিষয়, সাধারণত মহামারীতে বেশি বয়স্করা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু সোয়াইন ফ্লুতে শিশু আর তরুণদের আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল বেশি। পরে প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ায় এ মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এটি মনে করিয়ে দিয়েছিল, সংক্রমণ কত দ্রুত বৈশ্বিক রূপ নিতে পারে।

এইডস: ধীরে চলা নিঃশব্দ ঘাতক

এইডস পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ মহামারীর নাম। ধারণা করা হয়, ১৯২০ সালে শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের শরীরে আসে এইচআইভি ভাইরাস। ধীরে ধীরে যৌনসম্পর্ক, রক্ত ও অন্যান্য মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে এইডসে। এখনো আনুমানিক ৪০ মিলিয়ন মানুষ এই ভাইরাস বহন করছে, যার মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আফ্রিকায়। পূর্ণ প্রতিষেধক নেই, তবে ওষুধের উন্নতির ফলে রোগীরা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারছে। এটি মানবজাতিকে শিখিয়েছে সচেতনতা আর প্রতিরোধের গুরুত্ব।

এশিয়ান ফ্লু: পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু হয়ে বৈশ্বিক ধাক্কা

১৯৫৬ সালের শেষ দিকে চীনে প্রথম দেখা যায় এশিয়ান ফ্লু, যার উৎপত্তি হয়েছিল এভিয়ান ভাইরাস থেকে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, ভারত, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে। প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। সৌভাগ্যবশত, ১৯৫৭ সালের অক্টোবরেই ভ্যাকসিন তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসে।

স্প্যানিশ ফ্লু: মহাযুদ্ধের ভেতরে মৃত্যুর মহাযুদ্ধ

১৯১৮ থেকে ১৯২০—প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবী ইতিহাসের ভয়াবহতম মহামারীর মুখোমুখি হয়। স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ, যা সেই সময়ের বৈশ্বিক জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। আনুমানিক ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। এত বড় প্রাণহানি মানব ইতিহাসে আর কোথাও দেখা যায়নি। অনেক সমাজ, গ্রাম এমনকি গোত্রও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

মহামারী থেকে শিক্ষা: প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্যই টিকে থাকার চাবিকাঠি

বিগত শতাব্দীর এই ছয়টি মহামারী প্রমাণ করেছে, মানুষের অগ্রগতি যতই হোক না কেন, অদৃশ্য জীবাণুর কাছে আমরা এখনো দুর্বল। বন উজাড়, পরিবেশ দূষণ, প্রাণীজগতের আবাসভূমি ধ্বংস—এসবের মাধ্যমে মানুষই নিজের বিপদ ডেকে আনে। প্রতি মহামারীতে প্রতিষেধক আবিষ্কারে সময় লেগেছে বছরখানেক বা তারও বেশি, আর সেই ফাঁকেই কোটির পর কোটি প্রাণ ঝরে গেছে।

আজকের দিনে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কিংবা সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ আমাদের সামনে সতর্কবার্তা তুলে ধরে। প্রকৃতিকে রক্ষা করা, স্বাস্থ্যসচেতন হওয়া এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া এই পৃথিবীতে টিকে থাকার আর কোনো বিকল্প নেই।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular