হাঁটু ও মাজার ক্ষয়রোগ – কারণ, ঝুঁকি ও প্রতিরোধ
বর্তমানে হাঁটুর ও মাজার হাড় ক্ষয় রোগ (Osteoporosis) এবং আর্থ্রাইটিস বিশেষ করে নারীদের মধ্যে খুব সাধারণ একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত হলে শুধু চলাফেরার অসুবিধা হয় না, বরং দৈনন্দিন জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। প্রশ্ন হলো—এটি কেন বিশেষ করে নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়? পুরুষদের ক্ষেত্রে কেন তুলনামূলক কম হয়? আসুন, সহজ ভাষায় এই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি।
হাঁটুর হাড় ক্ষয়ের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো “ক্যালসিয়ামের অভাব”। ক্যালসিয়াম হাড়ের শক্তি ও ঘনত্ব বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য খনিজ। কিন্তু এই ক্যালসিয়াম শরীরে সঠিকভাবে শোষণ ও জমা হতে হলে ভিটামিন ডি দরকার হয়।
ভিটামিন ডি আমাদের খাবারে খুব সীমিত পরিমাণে থাকে। এটি সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে কিছুটা পাওয়া যায়। তবে এর প্রধান উৎস হলো সূর্যের আলো। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UVB) ত্বকে পড়লে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয়, যা ক্যালসিয়াম হাড়ে জমতে সাহায্য করে।
পুরুষেরা সাধারণত বাইরে বেশি সময় কাটান, তাই তাদের শরীরে পর্যাপ্ত সূর্যালোক লাগে এবং ভিটামিন ডি উৎপাদন ভালো হয়। অন্যদিকে নারীরা, বিশেষ করে গৃহিণীরা, ঘরের ভেতরেই বেশি সময় কাটান, ফলে তাদের শরীরে সূর্যালোকের অভাব দেখা দেয়। এর ফলেই ক্যালসিয়ামের ঘাটতি তৈরি হয় এবং হাঁটুর ও মাজার হাড় ক্ষয় রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
কাদের ঝুঁকি বেশি
শুধু নারীরাই নয়—যেসব পুরুষ সারাদিন এসি রুমে বা বদ্ধ পরিবেশে কাজ করেন, বাইরের আলো-হাওয়া তেমন পান না, তাদেরও একই সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে যারা শারীরিক শ্রম কম করেন ও রোদে খুব কম বের হন, তারা এই রোগের ঝুঁকিতে থাকেন।
এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—রোদে থাকা দরকার, কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা আছে। অতিরিক্ত রোদে দীর্ঘ সময় কাটালে ত্বকের ক্ষতি, পানিশূন্যতা, এমনকি ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। তাই সূর্যের আলো নিতে হলে সকালে বা বিকেলে, যখন রোদ তুলনামূলক কোমল থাকে, তখন নেওয়া উচিত।

হাড় ক্ষয়ের প্রাথমিক লক্ষণ
অনেকেই জানেন না যে তাদের হাড় ক্ষয় শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো খুব সূক্ষ্ম হতে পারে, যেমন—
* হাঁটুর ব্যথা বা ভারী লাগা
* দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে অস্বস্তি
* কোমরে বা মাজার ব্যথা
* সহজে হাড় ভেঙে যাওয়া বা ফ্র্যাকচার হওয়া
* উচ্চতা সামান্য কমে আসা
এই লক্ষণগুলো অবহেলা করলে সমস্যা দ্রুত বাড়তে পারে।
হাড় ক্ষয় ও আর্থ্রাইটিসের মধ্যে পার্থক্য
অনেকেই হাড় ক্ষয় রোগ ও আর্থ্রাইটিসকে একই ভাবে ভাবেন, কিন্তু আসলে পার্থক্য আছে—
*হাড় ক্ষয় (Osteoporosis) – মূলত হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, যা ভঙ্গুরতা বাড়ায়।
*আর্থ্রাইটিস (Arthritis) – হাড়ের জোড়ে (Joint) প্রদাহ ও ব্যথা, যা চলাফেরায় সমস্যা করে।
দুই ক্ষেত্রেই ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও সঠিক জীবনযাপন গুরুত্বপূর্ণ।
হাড় ক্ষয় প্রতিরোধের উপায়
এই রোগ প্রতিরোধে কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর পদ্ধতি আছে—
1. পর্যাপ্ত সূর্যালোক গ্রহণ – প্রতিদিন অন্তত ১৫–২০ মিনিট সকাল বা বিকেলের রোদে হাঁটুন।
2. ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার – দুধ, দই, পনির, ছোট মাছ (কাঁটাসহ), শাক-সবজি খাবারের তালিকায় রাখুন।
3. ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার – সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, মাশরুম।
4. শারীরিক ব্যায়াম – হালকা দৌড়, হাঁটা, সিঁড়ি ওঠা, যোগব্যায়াম—যা হাড়কে মজবুত করে।
5. অ্যালকোহল ও ধূমপান এড়ানো – এগুলো হাড়ের ক্ষয় দ্রুত বাড়ায়।
6. ওজন নিয়ন্ত্রণ – অতিরিক্ত ওজন হাঁটুর ওপর চাপ বাড়ায়।
যদি দীর্ঘদিন হাঁটুর বা মাজার ব্যথা থাকে, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যান। প্রয়োজনে হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা (Bone Density Test) করাতে পারেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসা সহজ হয়।

শেষ কথা
হাঁটুর ও মাজার হাড় ক্ষয় রোগ ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা একটি সমস্যা, যা প্রাথমিকভাবে বুঝে ব্যবস্থা নিলে বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। নারীদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হলেও, পুরুষরাও ঝুঁকিমুক্ত নন। সচেতনতা, সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত সূর্যালোক—এই কয়েকটি সহজ অভ্যাস জীবনভর হাড়কে সুস্থ রাখতে সাহায্য করতে পারে।




