হৃদরোগকে বলা হয় নীরব ঘাতক। আগে অনেকের ধারণা ছিল—শুধুমাত্র বয়স্ক মানুষই হৃদরোগে আক্রান্ত হন, তরুণদের ঝুঁকি নেই। কিন্তু আধুনিক গবেষণা এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। এখন ৩০ বছরের পর থেকেই, এমনকি তার আগেও, অনেক মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে হৃদরোগ শীর্ষে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩৭ সেকেন্ডে একজন মারা যান হৃদরোগে। আমাদের দেশেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক—প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩০%।
হৃদরোগ মানে শুধু হার্ট অ্যাটাক নয়
অনেকেই হৃদরোগ বলতে কেবল হার্ট অ্যাটাককে বোঝেন। বাস্তবে অনেক ধরনের হৃদরোগ রয়েছে-
হার্ট ফেইলিউর
– হৃদপিণ্ড যথাযথভাবে রক্ত পাম্প করতে না পারা।
করোনারি হার্ট ডিজিজ
– হৃদপিণ্ডের রক্তনালিতে চর্বি জমে রক্ত প্রবাহ কমে যাওয়া।
হার্ট অ্যাটাক
– হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
অ্যারিদমিয়া
– হৃদস্পন্দনের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বা কমে যাওয়া।
ঝুঁকির কারণগুলো কী?
বয়সের প্রভাব
পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪৫ বছর ও নারীদের ক্ষেত্রে ৫৫ বছরের পর ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে আধুনিক জীবনযাপন ও অনিয়মের কারণে এর আগেও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন।
পারিবারিক ইতিহাস
যাদের পরিবারে আগে হৃদরোগের ইতিহাস আছে, তাদের ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে বাবা-মা বা ভাইবোনের অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাক হলে সতর্ক থাকতে হবে।
লিঙ্গভেদে পার্থক্য
পুরুষদের তুলনায় নারীদের হার্ট অ্যাটাকের হার কিছুটা কম হলেও, মেনোপজের পর নারীদের ঝুঁকি দ্রুত বাড়ে।
উচ্চ রক্তচাপ
নিয়ন্ত্রণহীন রক্তচাপ হৃদপিণ্ডে চাপ তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ ডেকে আনে।
উচ্চ কোলেস্টেরল
রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে তা ধীরে ধীরে রক্তনালিতে জমে ব্লক তৈরি করে।
অতিরিক্ত ওজন
প্রতিটি অতিরিক্ত কেজি ওজন রক্তচাপ বাড়ায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
ডায়াবেটিস
দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণহীন রক্তে গ্লুকোজ থাকলে হার্টের রক্তনালি ও স্নায়ু নষ্ট করে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল
তামাকের বিষাক্ত রাসায়নিক রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ব্লকেজের ঝুঁকি বাড়ায়।
হৃদরোগের লক্ষণ—কখন সতর্ক হবেন?
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
* বুকের মাঝখানে তীব্র চাপ বা ব্যথা
* ব্যথা পিঠ, কাঁধ, বাহু বা গলায় ছড়িয়ে যাওয়া
* শ্বাসকষ্ট, ঘাম, মাথা ঘোরা, বমি ভাব
অ্যারিদমিয়া (হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা)
* হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত বা খুব ধীর হয়ে যাওয়া
* মাথা হালকা লাগা, বুক ধড়ফড় করা
* অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
হার্ট ফেইলিউর
* সামান্য পরিশ্রমেই শ্বাসকষ্ট
* পায়ে বা পেটে পানি জমা
* ক্রমাগত ক্লান্তি ও দুর্বলতা
প্রতিরোধে যা করবেন
১. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
* সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন, অতিরিক্ত চর্বি ও লবণ কমান।
* প্রতিদিন তাজা ফল ও শাকসবজি খান।
* ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
২. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
* রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও রক্তে শর্করা মাপুন।
* কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে দ্রুত চিকিৎসা নিন।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ

* নিয়মিত ব্যায়াম করুন—প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন।
* পেটের মেদ কমানোর চেষ্টা করুন।
৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকুন
*তামাকজাত সব পণ্য ও অ্যালকোহল হৃদরোগের শত্রু।
৫. মানসিক চাপ কমান
* ধ্যন, যোগব্যায়াম বা পছন্দের কাজে সময় দিন।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
* হঠাৎ বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করলে
* শ্বাস নিতে কষ্ট হলে
* হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক লাগলে
* অতিরিক্ত ঘাম বা দুর্বলতা এলে
দ্রুত চিকিৎসা নিলে হার্ট অ্যাটাকের ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।