মানুষের কৌতূহল সবসময়ই আকাশ ও মহাকাশ ঘিরে। রাতের আকাশে অসংখ্য তারা, উজ্জ্বল গ্রহ কিংবা ধূমকেতু দেখে আমরা অবাক হই। কিন্তু আমাদের বাসস্থান পৃথিবীসহ পুরো মহাকাশে যেটা সবচেয়ে কাছের এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা, সেটাই সৌরজগৎ।
সৌরজগতের গঠন
সৌরজগৎ গড়ে উঠেছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। সূর্য একদিকে আমাদের পৃথিবীর তাপ ও আলোর উৎস, অন্যদিকে গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু এবং অসংখ্য মহাজাগতিক বস্তুকে আকর্ষণ করে রাখার কেন্দ্র। মহাকর্ষ বলের কারণে আটটি গ্রহ নিয়মিত সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। এছাড়া রয়েছে শতাধিক উপগ্রহ, হাজার হাজার গ্রহাণু ও ধূমকেতু, যাদের মিলেই সৌরজগৎ পূর্ণতা পেয়েছে।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি: আমাদের ছায়াপথের রহস্য
সূর্য: সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্র
সূর্য হলো একটি মাঝারি আকারের আ্লোকিত নক্ষত্র, যার ভেতরে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের দহন থেকে উৎপন্ন হচ্ছে বিপুল আলোক ও তাপশক্তি। এটি পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড় এবং পৃথিবী থেকে গড়ে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সূর্যের পৃষ্ঠে মাঝে মাঝে কালো দাগের মতো কিছু দেখা যায়, যেগুলোকে বলা হয় সৌরকলঙ্ক। আসলে এগুলো হলো সূর্যের ভেতরের চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে সৃষ্ট অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা অঞ্চল।
সূর্য নিজের অক্ষে ঘুরে একবার সম্পূর্ণ আবর্তন শেষ করে প্রায় ২৫ দিনে। আর সেই সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে সৌরজগতের সব গ্রহ।
গ্রহসমূহ
- বুধ
সূর্যের সবচেয়ে কাছের ও ক্ষুদ্রতম গ্রহ বুধ। বায়ুমণ্ডল না থাকায় এখানে নেই বাতাস, পানি কিংবা মেঘ। দিনে এর তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ৪৩০° সেলসিয়াসে, আর রাতে নেমে যায় মাইনাস ১৮০° সেলসিয়াসে। বুধে এক বছর মানে মাত্র ৮৮ দিন।
- শুক্র
শুক্র হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম গ্রহ। ঘন কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভরা বায়ুমণ্ডল আর মেঘের কারণে একে বলা হয় সৌরজগতের উনুন। শুক্রেই ঘটে অ্যাসিড বৃষ্টি। মজার ব্যাপার হলো, এটি সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত—দুবার দেখা যায় এক বছরে। আর অন্যান্য গ্রহ যেখানে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘোরে, শুক্র ঘোরে উল্টো দিকে।
- পৃথিবী
আমাদের বাসস্থান পৃথিবীই সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। কারণ এখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন, পানি ও সঠিক তাপমাত্রা রয়েছে। পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ হলো চাঁদ, যা পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে বেড়ায় প্রতি ২৯ দিনে।
- মঙ্গল
লালচে রঙের জন্য মঙ্গলকে বলা হয় “লাল গ্রহ”। এখানে বিশাল গিরিখাত, পর্বত আর আগ্নেয়গিরি আছে। পানির অস্তিত্ব খুবই সামান্য, তবে বিজ্ঞানীরা এখনো খুঁজছেন জীবনের কোনো চিহ্ন আছে কি না।
- বৃহস্পতি
সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি। এর ভেতরে প্রাণ নেই, তবে আশেপাশে রয়েছে ৬৭টিরও বেশি উপগ্রহ। এর মধ্যে ইউরোপা আর গ্যানিমেড বিশেষভাবে আলোচিত, কারণ বিজ্ঞানীরা মনে করেন সেখানেও কোনো ধরনের জীবনের সম্ভাবনা থাকতে পারে।
- শনি
দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ শনি তার দৃষ্টিনন্দন বলয়ের জন্য বিখ্যাত। বরফ ও ধূলিকণার তৈরি এই বলয়গুলো শনিকে করেছে আলাদা। শনিরও বহু উপগ্রহ আছে, যার মধ্যে টাইটান সবচেয়ে বড়।
- ইউরেনাস
নীলাভ ইউরেনাসের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো এটি কাত হয়ে ঘুরে। অর্থাৎ, এর মেরু প্রায় সূর্যের দিকে ঝুঁকে থাকে। এতে দিন-রাতের সময়কাল অনেক দীর্ঘ হয়। ইউরেনাসেরও রয়েছে ১৩টি বলয় এবং ২৭টি উপগ্রহ।
- নেপচুন
সৌরজগতের শেষ গ্রহ নেপচুন। এটি সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে এবং তাই সবচেয়ে ঠান্ডা। এর বায়ুমণ্ডল মিথেন দিয়ে ভরা, যা একে নীলাভ আভা দেয়। নেপচুনে প্রচণ্ড ঝড়-বাতাস প্রবাহিত হয়। এর সবচেয়ে বড় উপগ্রহ হলো ট্রাইটন।
যেভাবে জানা গেল পৃথিবীর বয়স
গ্রহাণু ও ধূমকেতু
গ্রহগুলোর পাশাপাশি সৌরজগতে রয়েছে হাজারো গ্রহাণু ও ধূমকেতু। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে গ্রহাণুপুঞ্জের অবস্থান। আর ধূমকেতু হলো বরফ, ধূলিকণা ও গ্যাস দিয়ে তৈরি মহাজাগতিক বস্তু। সূর্যের কাছাকাছি এলে এগুলো লম্বা উজ্জ্বল লেজ তৈরি করে। বিখ্যাত হ্যালির ধূমকেতু প্রতি ৭৬ বছর পর পর পৃথিবী থেকে দেখা যায়।

উপসংহার
সৌরজগৎ শুধু গ্রহ-উপগ্রহ বা তারার সমষ্টি নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের মূলভিত্তি। সূর্য ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকা সম্ভব হতো না। তাই সৌরজগতের প্রতিটি উপাদান আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর রহস্য যত খুঁজছি, ততই সামনে আসছে নতুন নতুন তথ্য। আর এভাবেই মানুষের কৌতূহল আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মহাকাশের আরও গভীরে।