আজ আমাদের জীবনে মোবাইল ফোন এতটাই জরুরি হয়ে উঠেছে যে, এক মুহূর্তও এর বাইরে থাকা কষ্টকর। কথা বলা, ইমেইল পাঠানো, ছবি তোলা, ভিডিও দেখা—সবই আমরা হাতের মুঠোয় সেরে ফেলি। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন, এই মোবাইল ফোন কীভাবে এলো? এর যাত্রা শুরু হয়েছিল এক শতাব্দীরও বেশি আগে, আর সেই গল্প আজ আপনাদের শোনাবো।
স্বপ্নের বীজ: তারবিহীন যোগাযোগের ভাবনা
১৮৭৬ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করলেন। এর পর থেকেই বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করলেন—তার ছাড়া যোগাযোগ কি সম্ভব? ১৯০৬ সালে পাঞ্চ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, এক পুরুষ ও এক নারী হাতে ছোট রেডিও ডিভাইস নিয়ে কথা বলছে। মজার বিষয়, সেটি ছিল ভবিষ্যতের মোবাইল ফোনের এক রূপক ছবি।
১৯১০ সালে লার্স ম্যাগনাস এরিকসন নিজের গাড়িতে টেলিফোন স্থাপন করেন, যদিও সেটি তারযুক্ত ছিল। পরবর্তীতে ট্রেন, বিমান এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রেডিও টেলিফোন ব্যবহার শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪০-এর দশক) এই প্রযুক্তি বিশেষ করে সৈন্যদের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস: প্রাচীন অ্যাবাকাস থেকে আধুনিক মাইক্রোপ্রসেসর
প্রথম বাস্তব মোবাইল ফোন: মটোরোলার জয়ের গল্প
১৯৭৩ সাল—প্রযুক্তির ইতিহাসে এক মাইলফলক। মটোরোলার ভাইস প্রেসিডেন্ট জন মিশেল কোম্পানির জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী মার্টিন কুপারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন—বিশ্বের প্রথম হাতে ধরা মোবাইল ফোন তৈরি করতে হবে। কুপার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং সফল হলেন। ১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল তিনি নিউইয়র্কের সিক্সথ অ্যাভিনিউতে দাঁড়িয়ে প্রথম কল করেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী জোয়েল এঞ্জেলকে।
ফোনটির নাম ছিল ডায়না TAC (DynaTAC)। দেখতে ছিল ইটের মতো—ওজন ১ কেজি, লম্বা ৯ ইঞ্চি। ব্যাটারি চার্জ হতে অনেক সময় লাগত এবং ২০ মিনিটের বেশি কথা বলা যেত না। ১৯৮৩ সালে এর বাণিজ্যিক সংস্করণ বাজারে আসে, কিন্তু দাম ছিল আকাশছোঁয়া।

প্রযুক্তির বিবর্তন: ব্রিক ফোন থেকে স্মার্টফোন
প্রথমদিকে মোবাইল ফোন শুধুমাত্র কল করার জন্য ব্যবহৃত হতো। এরপর যুক্ত হলো কীপ্যাড, মেসেজ পাঠানো, ক্যামেরা, মিউজিক প্লেয়ার। এগুলোকে বলা হতো মাল্টিমিডিয়া ফোন।
পরে এল স্মার্টফোন—যেখানে আছে টাচস্ক্রিন, ইন্টারনেট, অ্যাপস, ভিডিও কলিং, অনলাইন গেম, ইমেইল, এমনকি অফিসের কাজও। এখন মোবাইল শুধু ফোন নয়—এটি আমাদের ব্যক্তিগত সহকারী, বিনোদন কেন্দ্র এবং তথ্যের ভান্ডার।
বিশ্বের প্রথম উড়ন্ত গাড়ি: কল্পকাহিনী থেকে বাস্তবের পথে অবিশ্বাস্য যাত্রা
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের যাত্রা
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন সেবা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে, হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের হাত ধরে। প্রথমে ছিল 2G, পরে আসে 3G ও 4G। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ইতিমধ্যে 5G চালু করেছে, আর বাংলাদেশও এর পথে এগোচ্ছে।
ব্যবহারকারীর আধিক্য বৃদ্ধি
১৯৯০ সালে যেখানে বিশ্বে মাত্র সাড়ে ১২ মিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারী ছিল, ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ বিলিয়নে। আজ বিশ্বের প্রায় ৮৭% মানুষ মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এবং কোটি কোটি মানুষের হাতে নিজস্ব ফোন।

শেষকথা:
মোবাইল ফোন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছে। হাতে ধরা ইট-আকৃতির যন্ত্র থেকে আজকের অত্যাধুনিক স্মার্টফোনে পৌঁছানোর এই যাত্রা প্রমাণ করে, প্রযুক্তি মানুষের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে।




