Tuesday, September 16, 2025
Google search engine
Homeদর্শনদর্শনের ইতিহাস পর্ব – ৬: ইখওয়ানুস সাফা বা পবিত্র ভ্রাতৃসংঘ

দর্শনের ইতিহাস পর্ব – ৬: ইখওয়ানুস সাফা বা পবিত্র ভ্রাতৃসংঘ

ইতিহাসে নবম থেকে দশম শতকের দিকে বসরা শহরে আবির্ভূত হয়েছিল একটি রহস্যময় দার্শনিক দল—ইখওয়ানুস সাফা। তাদের পূর্ণ নাম ছিল ইখওয়ানুস সাফা ওয়া খুল্লানাল ওয়াফা ওয়া আহলুল হামদ ওয়া আবনাউল মাজদ, যার অর্থ—পবিত্র ভ্রাতৃসংঘ, বিশ্বস্ত সুহৃদ, প্রশংসিত পরিবার ও মহত্ত্বের সন্তানগণ। প্রথমদিকে তারা ছিল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী, কিন্তু ধীরে ধীরে দর্শন, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণে এক অনন্য দার্শনিক সংঘে পরিণত হয়।

রহস্যময় সংগঠন সদস্য শ্রেণিবিন্যাস

ইখওয়ানুস সাফার কার্যক্রম গোপন রাখা হতো। সদস্য সংগ্রহ হতো গোপনে এবং চারটি শ্রেণিতে তাদের ভাগ করা হতো—

1. প্রথম স্তর (১৫–৩০ বছর): শিক্ষানবীশ, যাদের শিক্ষকের প্রতি আনুগত্য শেখানো হতো।

2. দ্বিতীয় স্তর (৩০–৪০ বছর): জ্ঞান ও রাজনীতির প্রায়োগিক শিক্ষা লাভকারী।

3. তৃতীয় স্তর (৪০–৫০ বছর): ঐশী বিধানাবলি অনুধাবনে মনোনিবেশকারী।

4. চতুর্থ স্তর (৫০ বছরের বেশি): প্রকৃত দার্শনিক ও প্রজ্ঞার অধিকারী।

তাদের সভা মাসে তিনবার হতো এবং সেখানে ধর্ম, রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে আলোচনা চলত।

রাসায়েল ইখওয়ানুস সাফা – জ্ঞানের বিশ্বকোষ

এই ভ্রাতৃসংঘের সবচেয়ে বড় অবদান হলো “রাসায়েল ইখওয়ানুস সাফা”, যেখানে ৫২টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে—

১৪টি যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক, ১০টি অধিবিদ্যা বিষয়ক, ১১টি জ্যোতির্বিদ্যা ও সুফিবাদ সম্পর্কিত, ১৭টি প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূগোল, আবহাওয়া প্রভৃতি বিজ্ঞান নিয়ে।

এটিকে অনেকেই সেই সময়ের দর্শন ও বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

দর্শন চিন্তাধারা

১. সংখ্যা তত্ত্ব:

তারা পিথাগোরিয়ানদের মতোই বিশ্বাস করতেন যে সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুর সাথে সংখ্যার সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে চার সংখ্যাকে তারা গুরুত্ব দিতেন—চার ঋতু, চার দিক, চার উপাদান (মাটি, পানি, আগুন, বাতাস)।

২. জ্যোতির্বিজ্ঞান:

তাদের মতে নক্ষত্র মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে। বৃহস্পতি ও শুক্র সৌভাগ্যের প্রতীক, আর শনি ও মঙ্গল দুর্ভাগ্যের প্রতীক।

৩. যুক্তিবিদ্যা:

এরিস্টটলের অনুসরণে তারা যুক্তিবিদ্যাকে পদার্থবিদ্যা ও অধিবিদ্যার মাঝে স্থান দিয়েছিলেন।

৪. সৃষ্টিতত্ত্ব:

তাদের মতে জগত আল্লাহর বিকিরণ দ্বারা বিকশিত। সূর্য থেকে আলো যেমন বের হয়, তেমনি মহত্ত্ব ও সদগুণ আল্লাহ থেকে বিকিরিত হয়। এভাবেই ক্রমে জগত ও জীবের উদ্ভব হয়েছে। তারা বিবর্তনধারার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন।

৫. মনোবিদ্যা নীতিবিদ্যা:

মানুষ ক্ষুদ্র বিশ্ব (Microcosm) আর মহাবিশ্ব বৃহৎ মানুষ (Macrocosm)। মানুষের আত্মা অলিখিত শ্লেটের মতো, যা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পূর্ণ হয়। বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমেই মানুষ সঠিক জীবনযাপন করতে পারে।

৬. ধর্ম দর্শন:

তারা ইসলামকে সর্বোত্তম ধর্ম মনে করলেও ধর্মকে কেবল আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাদের মতে চিন্তা, উপলব্ধি ও দর্শনের মাধ্যমে ধর্মের আসল তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব।

উপসংহার

ইখওয়ানুস সাফা ছিল এক অনন্য দার্শনিক সংঘ, যারা দর্শন, বিজ্ঞান, যুক্তি ও ধর্মকে একত্রে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের রাসায়েল ইখওয়ানুস সাফা গ্রন্থ জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে আজও আলোচিত। বলা চলে, তারা মুসলিম দর্শনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular