Tuesday, September 16, 2025
Google search engine
Homeদর্শনদর্শনের ইতিহাস পর্ব – ৪: মুসলিম দর্শনের স্বরূপ

দর্শনের ইতিহাস পর্ব – ৪: মুসলিম দর্শনের স্বরূপ

মানব সভ্যতার  ইতিহাসে মুসলিম দর্শন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাচীন ও আধুনিক দর্শনের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে মুসলিম চিন্তাবিদরা। গ্রীক দর্শনের প্রভাব, ইসলামের মৌলিক উৎস এবং বহিরাগত সংস্কৃতির সংস্পর্শে মুসলিম দর্শন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।

গ্রীক থেকে ইসলামি দর্শনে যাত্রা

খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ছয় শত বছর পূর্বে পৃথিবীতে চীন, ভারত, পারস্য ও গ্রীস – এই চারটি দর্শনচিন্তা সক্রিয় ছিল। গ্রীসের দর্শন আলেকজান্দ্রিয়া, রোম ও সিরিয়া হয়ে মুসলিম দর্শনের সাথে মিশে যায়। আধুনিক দুনিয়ায় যে গ্রীক দর্শনের প্রভাব দেখা যায়, তা মূলত মুসলমানদের হাত ধরে এসেছে। এরিস্টটল, প্লেটো ও নব্য-প্লেটোবাদের সঙ্গে কোরান ও হাদিসের শিক্ষা মিলিত হয়ে মুসলিম দর্শনের ভিত্তি গড়ে তোলে।

ইসলামি দর্শনের মূল ভিত্তি

ইসলাম একটি প্রায়োগিক ধর্ম। এর কেন্দ্রে রয়েছে কুরআন ও হাদিস। মুসলিম দর্শন বিভিন্ন সভ্যতার প্রভাব নিলেও তা কুরআনের আলোয় নতুন ব্যাখ্যা ও প্রাণ পেয়েছে।

কুরআনে বলা হয়েছে:

“তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা সেটা দ্বারা উপলব্ধি করে না; তাদের চোখ আছে, কিন্তু দেখে না; তাদের কান আছে, কিন্তু শোনে না।” (৭:১৭৯)

এভাবেই চিন্তা, জ্ঞান ও বুদ্ধির ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “জ্ঞানার্জনের জন্য যে গৃহ ত্যাগ করে, সে যেন আল্লাহর রাস্তায় হাঁটে।”

দর্শনের ইতিহাসঃ পর্ব ১।প্রাচীন গ্রীক দর্শনের উত্থান ও সক্রেটিস-পূর্ব দার্শনিকদের অবদান

মুসলিম দর্শনের উৎস

মুসলিম দর্শনের প্রধান উৎস হলো কুরআন ও হাদিস। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ইজমা (সম্মতি), কিয়াস (তুলনা) ও ইজতিহাদ (গভীর বিচার) ব্যবহৃত হয়েছে।

বাহ্যিক উৎস হিসেবে গ্রীক, পারস্য, ভারতীয় এবং প্রাক-আরবীয় চিন্তাধারার প্রভাবও লক্ষ করা যায়। ইসলাম যেহেতু একত্ববাদ ও সাম্যের ওপর দাঁড়ানো ধর্ম, তাই এর দর্শনও মানুষের সমতা, ন্যায়বিচার ও জ্ঞানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়।

জ্ঞানার্জনের তিন ধারা

মুসলিম দর্শনে জ্ঞানার্জনের তিনটি ধারা দেখা যায় –

1. প্রজ্ঞা (বুদ্ধি ও যুক্তি) – মুতাজিলারা এ ধারা গুরুত্ব দিয়েছেন।

2. প্রথা (ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা) – আশারীয়রা প্রথার ওপর জোর দিয়েছেন।

3. সজ্ঞা (আধ্যাত্মিক উপলব্ধি) – সুফিরা সজ্ঞাকে মুখ্য জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

মুসলিম দর্শনের মতবাদ সম্প্রদায়

সময়ের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বহিরাগত প্রভাবের কারণে মুসলিম দর্শনে বিভিন্ন মতবাদ ও সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।

তাদেরকে সাধারণভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়ঃ

1. ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্প্রদায় – খারিজি, সুন্নি ও শিয়া।

2. ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায় – মুরজিয়া, জাবারিয়া, কাদেরিয়া, সিফাতিয়া।

3. দার্শনিক সম্প্রদায় – মুতাজিলা, আশারীয়া, সুফি, ফালাসিফা।

এগুলো স্থায়ী বিভাজন নয়; বিভিন্ন মতবাদের মাঝে সংমিশ্রণও দেখা যায়।

আলোচিত বিষয় গবেষণার ক্ষেত্র

মুসলিম দর্শনে আলোচনা হয়েছে ধর্ম, নৈতিকতা, মন, আত্মার অমরতা, কার্যকারণ, স্থান-কাল, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ব্যাকরণ ও নন্দনতত্ত্বসহ অসংখ্য বিষয়ে। এখানে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বিজ্ঞান ও দর্শন একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা তৈরি করেছে।

উপসংহার

মুসলিম দর্শন মূলত কুরআন ও হাদিসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও তা বহিরাগত প্রভাব গ্রহণ করে বৈচিত্র্যময় হয়েছে। জ্ঞান, যুক্তি ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধনে এটি প্রাচীন ও আধুনিক দর্শনের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে। একদিকে মুতাজিলার যুক্তিবাদ, অন্যদিকে সুফিদের আধ্যাত্মিকতা এবং আশারীয়দের প্রথা – সব মিলেই মুসলিম দর্শন মানব সভ্যতার এক অনন্য অবদান।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular