মানবসভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গ্রিক দর্শনের ভূমিকা অসামান্য। প্লেটো ও সক্রেটিসের পর এরিস্টটল ও হেলেনিয় দর্শনের ধারা দর্শনচর্চাকে নতুন রূপ দেয়। আজকের আলোচনায় রয়েছে এরিস্টটলের জীবন, দর্শন ও তার প্রভাব, এবং হেলেনিয় দর্শনের বিভিন্ন ধারা।
এরিস্টটল: প্রাচীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ সালে মেসিডনিয়ার স্ট্যাগিরা শহরে জন্ম নেন এরিস্টটল। তার পিতা নিকোম্যাকাস ছিলেন রাজ দরবারের চিকিৎসক। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি এথেন্সে যান এবং প্লেটোর একাডেমিতে ভর্তি হন। সেখানে প্রায় বিশ বছর ধরে শিক্ষা ও গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।
পরবর্তীতে ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপ তাকে রাজপুত্র আলেকজান্ডারের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন আলেকজান্ডারের মহৎ ব্যক্তিত্ব গঠনে এরিস্টটলের বড় অবদান ছিল। আলেকজান্ডার দেশ জয়ের অভিযানে বের হলে এরিস্টটল এথেন্সে ফিরে এসে ৩৩৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নিজস্ব বিদ্যালয় “লাইসিয়াম” প্রতিষ্ঠা করেন। এখানকার শিক্ষার্থীরা হেঁটে হেঁটে আলোচনা করত, এজন্য তাদের “Peripatetics” বলা হতো।
প্লেটোর গুহার রূপকঃ জ্ঞান ও ভ্রম।
এরিস্টটলের দর্শনের বৈশিষ্ট্য
এরিস্টটল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে সত্যিকার জগত হিসেবে দেখতেন। তিনি অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জ্ঞানের ওপর জোর দেন। প্লেটোর স্বরূপতত্ত্বকে তিনি সমালোচনা করে বলেন, বাস্তব জগতের বাইরে কোনো আলাদা আদর্শ জগত কল্পনা করার প্রয়োজন নেই।
তার দর্শনের প্রধান দিকগুলো হলোঃ
অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত জীবনের পূর্ণতা বা উৎকর্ষ অর্জন। তিনি নৈতিকতায় “Golden Mean” বা মধ্যপন্থার তত্ত্ব দেন, যেখানে অতিরিক্ত বা ঘাটতি কোনো কিছুই কাম্য নয়।
তিনি রাজনীতিতে আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা দেন, যেখানে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার ভিত্তিতে শাসন করবে।
তার বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে “পলিটিক্স”, “নিকোম্যাকিয়ান এথিক্স”, “ফিজিক্স”, “মেটাফিজিক্স” ও “পোয়েটিক্স’।খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ সালে মাত্র ৬৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার জ্ঞান, দর্শন ও যুক্তিবাদী চিন্তা আজও মানব সভ্যতার ভিত্তি হয়ে রয়েছে।
হেলেনিয় দর্শনের বিকাশ
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর থেকে রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান পর্যন্ত সময়কে হেলেনিস্টিক যুগ বলা হয়। এ সময়ে নতুন নতুন দর্শনের স্কুল গড়ে ওঠে, যা মানুষের নৈতিকতা, জীবনযাপন ও মহাজগতের ব্যাখ্যার ওপর জোর দেয়।
স্টয়িকবাদ
স্টয়িকবাদ প্রতিষ্ঠা করেন সিতিয়ামের জেনো। তারা মনে করতেন মানুষের জীবনের লক্ষ্য হলো প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাঁচা। সম্পদ, স্বাস্থ্য বা মৃত্যুর চেয়ে বড় হলো সদগুণ। জ্ঞানী মানুষ কখনো বাইরের কষ্ট বা অভাবে দমে যায় না। আত্মনিয়ন্ত্রণই সুখের মূল চাবিকাঠি। পরবর্তীতে ক্লিনথেস, ক্রিসিপাস ও সেনেকা এ দর্শনের প্রচার করেন।
প্রচলিত মতবাদ (পর্ব ১): অজ্ঞেয়বাদ, ভাববাদ, ঐতিহাসিকতাবাদ, সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদ
এপিকুরোসবাদ
এপিকুরোস প্রতিষ্ঠিত এই মতবাদে সর্বোচ্চ সুখ মানে দুঃখ বা কষ্টের অনুপস্থিতি। তিনি ভোগবাদের পরিবর্তে মিতাচারী ভোগের পক্ষে ছিলেন। সহজ-সরল আনন্দ, মানসিক শান্তি ও দেহের সুস্থতাকে তিনি সুখের মূল হিসেবে দেখতেন। তার মতে জগৎ দৈবক্রমে চলে, কোনো দেবতা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে না।
নব্য-প্লেটোবাদ
নব্য-প্লেটোবাদ প্রতিষ্ঠা করেন আমোনিওস সাক্কাস, পরে তার শিষ্য প্লোতিনাস এটিকে সমৃদ্ধ করেন। তারা মনে করতেন আত্মার বিভিন্ন স্তর আছে। সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে একক শুভ সত্তা, এরপর বুদ্ধি, তারপর আত্মা এবং সবশেষে পদার্থ। তাদের মতে ধ্যান ও পবিত্রতার মাধ্যমে সেই শুভ সত্তার সঙ্গে মিলনই মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
উপসংহার
এরিস্টটল ও হেলেনিয় দর্শন মানব সভ্যতার চিন্তাধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এরিস্টটলের যুক্তিবাদী ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক চিন্তা আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করে। অন্যদিকে হেলেনিয় দর্শনের বিভিন্ন ধারা মানুষের নৈতিকতা, শান্তি ও জীবনযাপনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। আজও এসব দর্শন মানব জীবনের প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।