ভূমিকা
বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীর মানবসভ্যতার মূল ভিত্তি হলো কৃষি। খাদ্য, জীবিকা, অর্থনীতি—সব কিছুর শিকড়ই কৃষির মধ্যে নিহিত। তবে কৃষির এই সাফল্য একদিনে আসেনি। সনাতনী কৌশল থেকে শুরু করে আধুনিক যন্ত্রপাতি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়নই কৃষিকে করেছে টেকসই ও উৎপাদনশীল। তাই আজকের দিনে কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, অপরিহার্য।
কৃষি বিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ইতিহাস
বিজ্ঞান বলতে বোঝায় পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন। আর যখন এই জ্ঞান কৃষির ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়, তখন তাকে বলা হয় কৃষি বিজ্ঞান।
কৃষি বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হলো—ফসল উৎপাদন বাড়ানো, মাটির উর্বরতা রক্ষা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, রোগ-পোকার দমন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কৃষি বিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত জেন্সেটাল, যার আবিষ্কারের সুফল ভোগ করছে আজ পুরো পৃথিবী।
গরমে মানুষ কেন ঘামে – বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
কৃষিতে বিজ্ঞানের আগের চিত্র
অতীতে কৃষিকাজ ছিল পুরোপুরি সনাতনী। গরু বা মহিষ দিয়ে লাঙ্গল চালিয়ে জমি চাষ করা হতো। বীজের মান জানা যেত না, সেচ পুরোপুরি নির্ভর করত বৃষ্টির উপর। খরা, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি বা কীটপতঙ্গের আক্রমণে ফসল নষ্ট হয়ে যেত। ফলে দুর্ভিক্ষ ছিল নিত্যসঙ্গী।
একই জমিতে বারবার চাষের ফলে মাটির উর্বরতা কমে যেত। ভালো ফসল ও উন্নত বীজ সংগ্রহ ছিল প্রায় অসম্ভব।
আধুনিক কৃষিতে বিজ্ঞানের অবদান
- আধুনিক যন্ত্রপাতি:
শিল্প বিপ্লবের পরে কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, থ্রেসিং মেশিন, সেচ পাম্প—এসবের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বহুগুণে বেড়ে যায়। আজকের দিনে কৃষি যন্ত্রপাতি সম্পূর্ণ কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে।
- সেচ ও আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ:
বিদ্যুৎচালিত পাম্প, কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ব্যবস্থা, গ্রীনহাউস টেকনোলজি—এসবের মাধ্যমে কৃষকরা আবহাওয়া ও জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এমনকি মরুভূমিতেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
- উন্নতমানের বীজ:
বিজ্ঞানের গবেষণায় এসেছে হাইব্রিড বীজ। এসব বীজ থেকে বেশি ফলন পাওয়া যায়, কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হয়।
- রাসায়নিক সার ও কীটনাশক:
রাসায়নিক সার আবিষ্কারের ফলে ফসলের উৎপাদন অনেক গুণ বেড়েছে। কীটনাশক ব্যবহারে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়েছে। তবে অতিরিক্ত ব্যবহারে এর ক্ষতিকর প্রভাবও দেখা দিচ্ছে।
- হাইড্রোপনিক চাষ:
এটি আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত চাষ পদ্ধতি। এখানে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের শিকড় রেখে চাষ করা হয়। খরচ কম এবং উৎপাদন বেশি হওয়ায় উন্নত দেশগুলোতে এই পদ্ধতি ব্যাপক জনপ্রিয়।
বিশ্বের প্রথম উড়ন্ত গাড়ি: কল্পকাহিনী থেকে বাস্তবের পথে অবিশ্বাস্য যাত্রা
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সুফল
1. উৎপাদন বৃদ্ধি – বৈজ্ঞানিক কৌশল ব্যবহার করে একই জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
2. শ্রম ও সময় সাশ্রয় – আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করায় কৃষকের শ্রম কমছে এবং সময় বাঁচছে।
3. খাদ্য নিরাপত্তা – উন্নতমানের বীজ ও সার ব্যবহার করে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলা করা সহজ হয়েছে।
4. বাণিজ্যিক কৃষি – এখন শুধু নিজের চাহিদা পূরণ নয়, বরং রপ্তানি যোগ্য ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
5. আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি – শীত, গরম বা অনুর্বর এলাকাতেও এখন ফসল ফলানো যায়।
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের কুফল
যেখানে সুফল আছে, সেখানেই কিছু কুফলও দেখা যায়।
- ফরমালিন ব্যবহার করে শাকসবজি সংরক্ষণ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
- রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহারে জমি ও ফসল দুটোই বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে।
- কীটনাশক পানিতে মিশে দূষণ বাড়াচ্ছে।
- হাইব্রিড বীজের কারণে অনেক কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ করতে পারছে না, ফলে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
- যন্ত্রপাতির কারণে শ্রমের চাহিদা কমে যাচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে।
- কৃত্রিমভাবে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ প্রায়শই নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডেকে আনে।

ভবিষ্যৎ কৃষিতে বিজ্ঞান ও টেকসই উন্নয়ন
ভবিষ্যতের কৃষি কেবলমাত্র বিজ্ঞানের হাত ধরেই টেকসই হতে পারবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তার সংকট মোকাবিলা করতে হলে পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। জৈব সার, অর্গানিক চাষ, স্মার্ট এগ্রিকালচার এবং ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল মনিটরিং—এসবই হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতের কৃষির প্রধান ভিত্তি।
উপসংহার
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের কারণে আজ মানুষ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে, নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি হয়েছে আধুনিক। তবে এর ক্ষতিকর দিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে সুফলের চাইতে কুফলই বেশি হবে। তাই বিজ্ঞানের ব্যবহার হতে হবে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও টেকসই।