ভূমিকা
কম্পিউটার হলো আধুনিক বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার। আজকের দিনে এটি শুধু গণনার যন্ত্র নয়, বরং তথ্য সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ, গণনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র। তবে এই অবস্থানে আসতে কম্পিউটারকে পাড়ি দিতে হয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। চলুন জেনে নেওয়া যাক কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস ধাপে ধাপে।
প্রাচীনকালের গণনার সূচনা
লিখিত সংখ্যার আগে মানুষ আঙুল, নুড়ি পাথর, হাড় ও গাছের বাকল দিয়ে গণনা করতো।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪,০০০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় খাঁজকাটা হাড় পাওয়া যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০,০০০ বছর আগে ইসাঙ্গো হাড় ব্যবহার করা হতো, যেগুলো অনেকটা ট্যালির মতো।
এসবই ছিল প্রাচীন মানুষের প্রাথমিক গণনার উপকরণ।
অ্যাবাকাস: কম্পিউটারের সূচনা
খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০–২৩০০ অব্দে সুমেরীয় সভ্যতায় অ্যাবাকাসের ব্যবহার শুরু হয়। কাঠ বা প্লাস্টিকের ফ্রেমে সাজানো পুঁতি দিয়ে তৈরি হতো অ্যাবাকাস। এটি যোগ-বিয়োগের কাজে ব্যবহৃত হতো।
চীন, জাপান ও ভারতের মতো অঞ্চলে অ্যাবাকাস ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা আধুনিক কম্পিউটারের প্রথম ধাপ বলে ধরা হয়।

প্যাসকেল ও লিবনিজের গণনাযন্ত্র
১৬৪২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল প্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন।
১৬৭২ সালে জার্মান গণিতবিদ গটফ্রাইড উইলহেলম লিবনিজ প্যাসকেলের ভিত্তিতে রেকোনার তৈরি করেন, যা যোগ-বিয়োগের পাশাপাশি গুণ, ভাগ এবং বর্গমূলও করতে পারতো।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল: স্তর, গঠন ও আমাদের জীবনে এর গুরুত্ব
চার্লস ব্যাবেজ ও আধুনিক কম্পিউটারের ধারণা
উনিশ শতকে ইংরেজ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ ডিফারেন্স ইঞ্জিন ও পরবর্তীতে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরি করেন।
এতে ছিল গাণিতিক হিসাব, স্মৃতিশক্তি ও যুক্তি নির্ভর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। এটি পাঞ্চ কার্ডে চালিত হতো। তাই ব্যাবেজকে বলা হয় “আধুনিক কম্পিউটারের জনক”।

এডা লাভলেস: প্রথম প্রোগ্রামার
লর্ড বাইরনের কন্যা এডা লাভলেস ব্যাবেজের যন্ত্রে কাজ করে সংখ্যা গণনার জন্য প্রথম অ্যালগরিদম তৈরি করেন। এজন্য তাকেই বলা হয় ইতিহাসের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার।
অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম: প্রথম অ্যানালগ কম্পিউটার
প্রাচীন গ্রীকরা গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করতো সেটি হলো অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম।
১৯০১ সালে এটি উদ্ধার করা হয়। সূর্য, চন্দ্রগ্রহণ ও অলিম্পিক গেমসের সময় নির্ণয়ে যন্ত্রটি ব্যবহৃত হতো।
বিশ্বের প্রথম উড়ন্ত গাড়ি: কল্পকাহিনী থেকে বাস্তবের পথে অবিশ্বাস্য যাত্রা
বাইনারি লজিক ও জর্জ বুল
১৭০২ সালে লিবনিজ বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি (০ ও ১) প্রবর্তন করেন। জর্জ বুল ১৮৫৪ সালে বুলিয়ান বীজগণিত প্রকাশ করেন। এই দুটি আবিষ্কার আধুনিক ডিজিটাল কম্পিউটারের ভিত্তি গড়ে তোলে।
অ্যালান টুরিং: কম্পিউটার বিজ্ঞানের পথিকৃৎ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যালান টুরিং জার্মানির এনিগমা কোড ভাঙার জন্য বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেন। তার প্রস্তাবিত টুরিং মেশিন আধুনিক প্রোগ্রামেবল কম্পিউটারের ভিত্তি।
এজন্য তাকে বলা হয় “কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক”।
আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কার
Mark-1 (১৯৪৪) – প্রথম ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিজিটাল কম্পিউটার।
ENIAC (১৯৪৬) – প্রথম প্রজন্মের ইলেকট্রনিক কম্পিউটার।
UNIVAC-1 (১৯৫১) – প্রথম বাণিজ্যিক কম্পিউটার।
ট্রানজিস্টর (১৯৪৮) ও ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আবিষ্কারের ফলে কম্পিউটার ছোট, দ্রুত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
মাইক্রোপ্রসেসর (১৯৭১, Intel) – কম্পিউটারকে এনে দেয় সাশ্রয়ী ও ব্যক্তিগত রূপ।
বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে, যা IBM 1620 মডেল ছিল এবং স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে।
উপসংহার
কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস আসলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের ইতিহাস। অ্যাবাকাস থেকে শুরু করে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর কম্পিউটার—প্রতিটি ধাপই মানব সভ্যতার জন্য একেকটি মাইলফলক। ভবিষ্যতে এই যন্ত্রই হতে যাচ্ছে মানুষের সেরা সহচর।




