বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আজ উন্নয়নশীল পর্যায়ে রয়েছে। এরা এখনো উন্নত হয়নি, তবে অনুন্নতও নয়। উন্নয়নশীল দেশ মানে সেইসব দেশ, যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে—পরিকল্পনা, কৌশল এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করছে।
অর্থাৎ, যেসব দেশের জীবনযাত্রার মান তুলনামূলকভাবে নিম্ন, জাতীয় আয়ের পরিমাণ কম, শিল্প ও কৃষি ব্যবস্থা এখনো সম্পূর্ণ আধুনিক হয়নি, কিন্তু পরিবর্তনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে—তাদের আমরা উন্নয়নশীল দেশ বলি।
উন্নয়নশীল দেশের প্রধান অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য
১. ক্রমবর্ধমান জাতীয় আয়
উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি উন্নতির পথে থাকায় তাদের জাতীয় আয় প্রতি বছর ধীরে ধীরে বাড়ে। এর প্রভাব পড়ে মাথাপিছু আয়ের ওপরও—যদিও তা উন্নত দেশের তুলনায় কম, তবে ধীরে ধীরে তাদের অগ্রগতি হয়।
২. সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার না হওয়া
প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার উন্নত দেশের মতো এখনো হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাব, এবং কখনো কখনো ভুল বিনিয়োগ, এই সীমাবদ্ধতার বড় কারণ। তবে এসব দেশ সম্পদ ব্যবহারে উন্নতির জন্য সচেষ্ট থাকে।
উন্নত দেশের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য
৩. বেকারত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়া
এদের বেকারত্বের হার অনুন্নত দেশের মতো বেশি নয়, আবার উন্নত দেশের মতো শূন্যও নয়। শিল্প, কৃষি ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে বেকারত্ব কমায়।
৪. বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি
দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামো, আইন-কানুন এবং বাজারব্যবস্থায় সংস্কার আনা হয়। অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ অর্থনীতির গতি বাড়ায়।
৫. নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা
শিল্পায়ন উন্নয়নশীল দেশের বড় লক্ষ্য। নতুন শিল্প স্থাপন ও বিদ্যমান শিল্পকে প্রসারিত করার মাধ্যমে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।

৬. কৃষির আধুনিকায়ন
বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশ কৃষিনির্ভর। তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি, সেচ ব্যবস্থা, উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সচেষ্ট, যাতে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটায় তা নয়, সাথে রপ্তানিও করা যায়।
৭. কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি
এসব দেশে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ভোকেশনাল শিক্ষা ও শিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনগণকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে পরিণত করা হয়। দক্ষ জনশক্তি বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বৈদেশিক মুদ্রা আনে।
অর্থনীতি: সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
৮. বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা
এ সকল দেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ও আমদানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নতি জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।
৯. সঞ্চয় ও মূলধন গঠন
আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ে। সঞ্চয় থেকে মূলধন তৈরি হয়, যা পুনরায় বিনিয়োগ হয়ে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়।
১০. সামাজিক শ্রেণী বিভাজন
উন্য়নশীল দেশে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর পার্থক্য স্পষ্ট। আয় ও সম্পদের অসম বণ্টন এই বৈষম্যের কারণ।
১১. আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য রক্ষা
বিশেষ পণ্য, দক্ষ শ্রমশক্তি ও সেবা রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা হয়।
উপসংহার
উন্নয়নশীল দেশগুলো মূলত পরিবর্তনের পথে রয়েছে। উন্নত দেশের প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও শিল্প নীতি থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা নিজেদের অর্থনীতি শক্তিশালী করছে। ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে, এসব দেশ একদিন উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে পারবে—যদিও পথটি দীর্ঘ ও চ্যালেঞ্জে ভরা।