Tuesday, November 4, 2025
Google search engine
Homeবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়: উৎপত্তি, প্রভাব ও সতর্কতা

বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়: উৎপত্তি, প্রভাব ও সতর্কতা

ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান সমুদ্রের পাশে। দক্ষিণে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর এই ভূখণ্ডকে যেমন মাছ ও সামুদ্রিক সম্পদের দান দিয়েছে, তেমনি বারবার উপহার দিয়েছে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল সমতল ভূমি হওয়ায় এসব দুর্যোগ সহজেই প্রবেশ করে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনে। ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে ছোট আঘাতও মুহূর্তে রূপ নেয় বড় বিপর্যয়ে।

ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম কাহিনি

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় মূলত সমুদ্র থেকে। তবে শুধুমাত্র সমুদ্রই দায়ী নয়, এর সঙ্গে জড়িত থাকে সূর্যের তীব্র তাপ, বায়ুর চাপের পার্থক্য ও পৃথিবীর নিজস্ব ঘূর্ণন। বিষুবীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপ সরাসরি পড়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এর ফলে হালকা বায়ু উপরে উঠে যায় আর ভারী বায়ু নিচে নেমে আসে। এই শূন্যতা পূরণে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে ছুটে আসে প্রবল বেগের বাতাস।

পৃথিবীর অক্ষীয় ঘূর্ণনের কারণে এই বায়ুপ্রবাহ সরল পথে না গিয়ে পাক খেয়ে ঘুরতে থাকে। এভাবেই চোঙ আকৃতির বিশাল এক ঘূর্ণি তৈরি হয়, যার কেন্দ্রীয় অংশ সবচেয়ে বিপজ্জনক। প্রতিবারই নতুন বায়ু এসে এই ঘূর্ণির শক্তি বাড়ায়, ফলে ঝড় ক্রমেই প্রবল হয়ে ওঠে।

বিশ্বে ঘূর্ণিঝড়ের ভিন্ন ভিন্ন নাম

একই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও ভৌগলিক অবস্থানের ভেদে এর নাম ভিন্ন।

  • প্রশান্ত মহাসাগরের চীন ও জাপান উপকূলে এটি পরিচিত টাইফুন নামে
  • আটলান্টিক মহাসাগরে এর নাম হারিকেন
  • বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে পরিচিত সাইক্লোন নামে
  • বাংলার মানুষের মুখে এর নাম তুফান
  • আর স্থলভাগে সৃষ্ট ক্ষুদ্র অথচ প্রবল ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় টর্নেডো

বিউফোর্ট স্কেল সতর্ক সংকেত

ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা মাপার জন্য ব্যবহৃত হয় বিউফোর্ট স্কেল। ফ্রান্সিস বিউফোর্ট নামের এক নৌবাহিনী অ্যাডমিরাল এটি তৈরি করেন। যন্ত্র ছাড়াই গাছের পাতা, ডাল কিংবা ধোঁয়ার গতিবেগ দেখে ঝড়ের শক্তি নির্ণয় সম্ভব এ স্কেলের মাধ্যমে।

বাংলাদেশে প্রচলিত সতর্ক সংকেত এই স্কেলের ভিত্তিতেই দেওয়া হয়।

  • হালকা বাতাসে পাতা দুললে গতি ৬–১২ কিলোমিটার, দেওয়া হয় ২ নম্বর সংকেত
  • কচি ডাল ভেঙে পড়লে গতি ৬১–৭৪ কিলোমিটার, তখন ৮ নম্বর সংকেত
  • বড় গাছ উপড়ে পড়লে গতি ৮৮–১০২ কিলোমিটার, দেওয়া হয় ১০ নম্বর সংকেত
  • আর ১২০ কিলোমিটারের বেশি হলে ১২ নম্বর সংকেত, তখন আশঙ্কা থাকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের

বাংলাদেশের জন্য ঘূর্ণিঝড় কেন ভয়াবহ

ভূপ্রকৃতিগত কারণেই ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সমতল ভূমি ও ঘনবসতি ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে বহুগুণে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হলে লাখো মানুষ মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রামীণ ঘরবাড়ি, ফসলের জমি, গবাদিপশু থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থা—সবকিছু এক ঝটকায় ভেঙে পড়ে।

ইতিহাসে নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা রয়েছে। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। পরবর্তীতেও ১৯৯১ ও ২০০৭ সালের সিডর দেশে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

আধুনিক প্রস্তুতি সতর্কতা

আজকের দিনে আবহাওয়া অধিদপ্তরের উন্নত পূর্বাভাস প্রযুক্তি ও উপকূলীয় আশ্রয়কেন্দ্র মানুষকে আগাম সতর্ক হতে সাহায্য করছে। স্যাটেলাইট চিত্র, রাডার ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আগেভাগেই বিপদ সংকেত ঘোষণা করা যায়। তবে সমস্যাটা থেকে যায় বাস্তবায়নে। সংকেত জারি হলেও অনেক সময় মানুষ নিরাপদ স্থানে সরতে চায় না, যার কারণে প্রাণহানি বেড়ে যায়।

ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের জন্য অবধারিত এক প্রাকৃতিক বাস্তবতা। তবে সঠিক প্রস্তুতি ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে।

উপকূলীয় অঞ্চলে আরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ

ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী বাঁধ ও ম্যানগ্রোভ বন সম্প্রসারণ

দ্রুত সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা

জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও মহড়া আয়োজন

দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও দ্রুততা

উপসংহার: প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের শিক্ষা

ঘূর্ণিঝড় কোনো নতুন ঘটনা নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ ভূখণ্ড এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করছে। তবে আধুনিক প্রযুক্তি ও মানুষের সচেতনতা দুর্যোগ মোকাবিলায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। ঘূর্ণিঝড় থামানো সম্ভব নয়, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের শিক্ষা নিয়েই বাংলাদেশকে এগোতে হবে টেকসই উন্নয়নের পথে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular